দিল্লির আধিপত্য নয়, বাংলাদেশের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত চায় জনগন
বিকল্প বাজার খোঁজা এবং যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভিয়েতনাম ও ব্রাজিলের মতো দেশে তুলা ও খাদ্যশস্য আমদানি বাড়ানো বাংলাদেশের জন্য জরুরি। নাহলে একতরফা নির্ভরতা অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বকে দুর্বল করে তুলতে পারে।
দিল্লির আধিপত্য নয়, বাংলাদেশের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত চায় জনগন
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এক নতুন মোড় নেয়। গত এক বছরে দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক টানাপড়েন, কূটনৈতিক বাকযুদ্ধ এবং পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপে চিহ্নিত হয়েছে। দিল্লি ঢাকাকে ভিসা নীতি থেকে শুরু করে বাণিজ্য ও সীমান্ত ইস্যুতে একাধিকবার চাপ দেওয়ার চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশের ভেতরে অনেকে এটিকে "দিল্লির আধিপত্যবাদী কৌশল" হিসেবে বর্ণনা করছেন। তবে অর্থনীতির পরিসংখ্যান বলছে ভিন্ন কথা—রাজনৈতিক উত্তেজনা বাণিজ্য সম্পর্ককে বড় ধরনের আঘাত হানতে পারেনি। এবিষয়ে বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিক বনিক বার্তা বিস্তারিত সংবাদ প্রকাশ করেছে।
অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানের চিত্র:
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারত বাংলাদেশে রফতানি করেছে প্রায় ১ হাজার ১৪৯ কোটি ডলারের পণ্য, যা আগের বছরের তুলনায় ৩.৭৯% বেশি। অর্থাৎ রাজনৈতিক টানাপড়েনের পরও আমদানির প্রবাহ অটুট থেকেছে, এমনকি কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে খাদ্যশস্য, তুলা, সুতা এবং বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রগুলোয় ভারতের প্রভাব স্পষ্ট।
অত্যাবশ্যকীয় পণ্যে ভারতের একচেটিয়া প্রভাব:
বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ সংকট তৈরি হলেই ভারতই হয়ে ওঠে প্রধান আমদানির উৎস। সম্প্রতি পেঁয়াজ ও চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলে সরকার আবারো ভারতের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়। ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি শুরু হতেই পাইকারি ও খুচরা বাজারে দাম কমে আসে। একইভাবে বোরো মৌসুম শেষে চালের ঘাটতি মেটাতে ভারত থেকে রেকর্ড পরিমাণ চাল আমদানি হয়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারত থেকে চাল আমদানি বেড়েছে ২১৭৪ শতাংশ—যা ভারতের প্রতি বাংলাদেশের খাদ্যনির্ভরতা আরও স্পষ্ট করে তুলছে।
পোশাক শিল্পে কাঁচামালের নির্ভরতা:
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প, যা দেশের রফতানি আয়ের প্রধান উৎস, এখনো বড়ভাবে ভারতের তুলা ও সুতার ওপর নির্ভরশীল। রাজনৈতিক টানাপড়েনের সময় স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করলেও সমুদ্রপথে আমদানি চলমান থাকে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য বলছে, আমদানির পরিমাণে উল্লেখযোগ্য হ্রাস হয়নি। এর ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে ভারতের ভূ-অর্থনৈতিক প্রভাব অটুট রয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানিতে নির্ভরশীলতা:
প্রতিদিন গড়ে ১,৭৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশে সরবরাহ করছে ভারত, যা জাতীয় গ্রিডের ১৫ শতাংশের বেশি। আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাওনা পরিশোধে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আগের সরকারের চেয়ে বেশি তৎপর। পাশাপাশি সীমান্তবর্তী পাইপলাইনের মাধ্যমে ডিজেল ও পেট্রোল আমদানি বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তাকে একপ্রকার ভারতের হাতে ছেড়ে দিচ্ছে।
দিল্লির চাপ ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া:
বিশ্লেষকদের মতে, দিল্লি সাম্প্রতিক সময়ে ভিসা সীমাবদ্ধতা, সীমান্তে অতিরিক্ত নজরদারি ও ব্যবসায়িক লেনদেনে বিলম্ব ঘটিয়ে বাংলাদেশের ওপর কূটনৈতিক চাপ তৈরি করেছে। সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, “বাংলাদেশ ভৌগোলিক বাস্তবতায় ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। তবে এ সম্পর্ককে দিল্লি যেভাবে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে, তা স্বাভাবিক বাণিজ্যিক সম্পর্ককে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।”
তিনি সতর্ক করে বলেন, বিকল্প বাজার খোঁজা এবং যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভিয়েতনাম ও ব্রাজিলের মতো দেশে তুলা ও খাদ্যশস্য আমদানি বাড়ানো বাংলাদেশের জন্য জরুরি। নাহলে একতরফা নির্ভরতা অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বকে দুর্বল করে তুলতে পারে।
দিল্লি-বিরোধী সুর বাড়ছে:
বাংলাদেশি ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর একাংশ মনে করছে, দিল্লির নীতিতে ইচ্ছাকৃতভাবে আমদানি-রফতানির গতি ধীর করা হচ্ছে যাতে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ে। আইবিসিসিআই-এর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ বলেন, “যেসব বন্দরে আগে প্রতিদিন ৩০০-৪০০ ট্রাক আসত, এখন সেখানে ১৫০ ট্রাক আসছে। এটি স্পষ্টত রাজনৈতিক চাপের ইঙ্গিত।”
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা:
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলে সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে পারে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের উচিত ভারতনির্ভর বাণিজ্য কমিয়ে বহুমুখী উৎস খোঁজা। সাম্প্রতিক মার্কিন তুলা আমদানি চুক্তিগুলোকে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।