বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিতে আওয়ামী বিরোধী কোটায় চেয়ারম্যান, কিন্তু পুনর্বাসন শুধু আওয়ামী লীগ
বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি মানবিক সেবার প্রতিষ্ঠান হলেও এর নেতৃত্বে রাজনৈতিক প্রভাব ও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ দিনদিন স্পষ্ট হচ্ছে। বর্তমান চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) অধ্যাপক ডা. মোঃ আজিজুল ইসলামের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই আওয়ামী ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুনর্বাসন, বিতর্কিত নিয়োগ ও পদোন্নতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি কার্যত একপক্ষীয় রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় পরিচালিত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। এতে সোসাইটির নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়ে মানবিক কর্মকাণ্ডও বিতর্কের মুখে পড়ছে।
বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিতে আওয়ামী বিরোধী কোটায় চেয়ারম্যান, কিন্তু পুনর্বাসন শুধু আওয়ামী লীগ
আওয়ামী বিরোধী কোটায় চেয়ারম্যান, কিন্তু পুনর্বাসন শুধু আওয়ামী ঘনিষ্ঠদের—প্রশ্ন উঠছে চেয়ারম্যান কাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে?
বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির বর্তমান চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) অধ্যাপক ডা. মোঃ আজিজুল ইসলাম দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই প্রতিষ্ঠানটিতে ব্যাপক রাজনৈতিক পুনর্বাসন, আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে পদোন্নতি ও বদলির অভিযোগে ঘিরে নতুন বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
সোসাইটির অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা গেছে, চেয়ারম্যান তার ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) সোহাগ মিয়া, উপ-মহাসচিব সুলতান আহমেদ ও পরিচালক ডা. শাহানা জাফরকে নিয়ে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট গঠন করেন। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আওয়ামী আমলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় চাকুরীচ্যূত ১৭ জন কর্মকর্তাকে পূনর্বহালের নামে চলছে নানান নাটক। তার মধ্যে বঙ্গবন্ধু পরিষদের ৪১ নং সদস্য জনাব আজরুদ্দিন সাফদারকে ডেকে এনে চাকুরীতে পূনর্বহাল করা বর্তমানে জাতীয় সদরে প্রশাসন বিভাগের সহকারী পরিচালক। অন্যরা ফ্যাসিষ্ট বিরোধী বিধায় তাদেরকে এখনো পূনর্বহাল করা হয়নি!
উপ-মহাসচিব সুলতান আহমেদকে “আওয়ামী পুনর্বাসনের মাস্টারমাইন্ড” হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। তিনি স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. রোকেয়া সুলতানার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন এবং আওয়ামী সরকারের আমলে ২০২২ সালের ৩ নভেম্বর রেড ক্রিসেন্টে নিয়োগ পান। অভিযোগ রয়েছে, তার অবৈধ নিয়োগের বিরুদ্ধে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আনুষ্ঠানিক আপত্তি ও গণস্বাক্ষর সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে।
পরিচালক রেজাউল করিম, বঙ্গবন্ধু পরিষদের অন্যতম সংগঠক হিসেবে পরিচিত, তাকেও চেয়ারম্যান পদোন্নতি দিয়েছেন। একইভাবে বঙ্গবন্ধু পরিষদের সদস্য সেলিম আহমেদ, এ.এস.এম. আক্তার এবং সাবিনা ইয়াসমিনকে আর্থিক লেনদেনের বিনিময়ে পরিচালক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
আওয়ামী পুনর্বাসনের তালিকা
১) সুলতান আহমেদ
আগে পদবী: স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. রোকেয়া সুলতানার ঘনিষ্ঠ সহযোগী।
এখন: বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির উপ-মহাসচিব (Deputy Secretary General) (২০২২ সালের ৩ নভেম্বর থেকে)।
২) ডা. রোকেয়া সুলতানা
আগে পদবী: স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী হওয়ার আগে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ব্যবস্থাপনা পরিষদের সদস্য (২০২৪–২০২৬ মেয়াদে)।
রাজনৈতিক পরিচয়: আওয়ামী সরকারে প্রতিমন্ত্রী।
৩) রেজাউল করিম
আগে পদবী: বঙ্গবন্ধু পরিষদ, রেড ক্রিসেন্ট শাখার সদস্য (ক্রমিক নং ৩০)।
এখন: সোসাইটির DCRM বিভাগের পরিচালক।
৪) সেলিম আহমেদ
আগে পদবী: বঙ্গবন্ধু পরিষদের সদস্য।
এখন: রেড ক্রিসেন্টের ভাসানচর অপারেশনের পরিচালক।
৫) এ.এস.এম. আক্তার
আগে পদবী: বঙ্গবন্ধু পরিষদের সদস্য।
এখন: সোসাইটির সিপিপি (Cyclone Preparedness Programme) বিভাগের পরিচালক।
৬) সাবিনা ইয়াসমিন
আগে পদবী: বঙ্গবন্ধু পরিষদের সদস্য।
এখন: ট্রেনিং বিভাগের পরিচালক।
৭) মিজানুর রহমান
আগে পদবী: অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক। আওয়ামী ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি, বোর্ড সদস্য রাজিয়া সুলতানা লুনার স্বামী।
এখন: চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তে বারবার চুক্তিভিত্তিক পুনঃনিয়োগপ্রাপ্ত পরিচালক।
৮) এ.এইচ.এম. মাইনুল ইসলাম
আগে পদবী: পরিচালক, ফাইন্যান্স বিভাগ (অবসরপ্রাপ্ত)।
এখন: অবসরোত্তর সময়েও বারবার মেয়াদবর্ধিত পরিচালক।
৯) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ডা. এস. এম. হুমায়ুন কবির
আগে পদবী: আওয়ামী স্বাচিপ নেতা, দুর্নীতির অভিযোগে বদলি হওয়া কর্মকর্তা।
এখন: ১৫ এপ্রিল ২০২৫ থেকে রক্ত কর্মসূচির পরিচালক পদে পুনর্বহাল।
১০) নাজমা পারভীন
আগে পদবী: মাগুরা জেলা মহিলা লীগের নেত্রী, স্কুল শিক্ষিকা।
এখন: সরাসরি পরিচালক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত, পরে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় বদলি।
১১) কাজী আসাদ
আগে পদবী: বঙ্গবন্ধু পরিষদের সদস্য।
এখন: ম্যানেজিং বোর্ডের পিএস পদে পুনর্বহাল।
বিশেষ সুবিধা: তার স্ত্রী মনিরা খাতুনকে আর্থিক লেনদেনে হলি ফ্যামিলি মেডিকেল কলেজে জুনিয়র অফিসার পদে নিয়োগ।
১২) তৌহিদুর রহমান নয়ন
আগে পদবী: বঙ্গবন্ধু পরিষদের আলোচিত ক্যাডার।
এখন: চেয়ারম্যানের পিএস-এর মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনের বিনিময়ে সুবিধাজনক স্থানে বদলি।
১৩) হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ
আগে অবস্থা: মিশ্র রাজনৈতিক কর্মী।
এখন: চেয়ারম্যান আজিজুল ইসলাম একসাথে ৩২ জন আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পদোন্নতি দেন।
বিতর্কিত পুনঃনিয়োগ ও মেয়াদবৃদ্ধি
অবসরে যাওয়া বিতর্কিত পরিচালক মোঃ মিজানুর রহমানকে একাধিকবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেন চেয়ারম্যান, বোর্ড সদস্যদের মতামত উপেক্ষা করে। মিজানুর রহমান আওয়ামী ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি এবং বঙ্গবন্ধু পরিষদের উপদেষ্টা রাজিয়া সুলতানা লুনার স্বামী। তার বিরুদ্ধে বিএনপির নয়াপল্টন কার্যালয়ে হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে।
একইভাবে, ফাইন্যান্স বিভাগের পরিচালক এ.এইচ.এম. মাইনুল ইসলামকেও অবসরোত্তর সময়ে বারবার মেয়াদ বাড়িয়ে রাখা হয়েছে।
দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার পুনর্বহাল
আওয়ামী স্বাচিপ নেতা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ডা. এস. এম. হুমায়ুন কবিরকে ২০২৫ সালের ১৫ এপ্রিল রক্ত কর্মসূচির পরিচালক পদে পুনর্বহাল করা হয়। তিনি দুর্নীতির কারণে পূর্বে হেডকোয়ার্টার থেকে বদলি হয়েছিলেন।
একই তারিখে মাগুরা জেলা মহিলা লীগের নেত্রী নাজমা পারভীনকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় বদলি করা হয়, যিনি সাবেক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আবদুল ওয়াহাবের বোন। অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধু পরিষদের সদস্য কাজী আসাদকে বোর্ডের পিএস পদে পুনর্বহাল করা হয়েছে এবং তার স্ত্রীকেও আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে হলি ফ্যামিলি মেডিকেল কলেজে নিয়োগ দেওয়া হয়।
অভিযোগ রয়েছে, চেয়ারম্যান শুধুমাত্র আওয়ামী ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি দিয়েছেন। হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের ৩২ জন আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তা পদোন্নতি পেলেও অন্তত ১৫ জন জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী কর্মকর্তাকে বদলি ও হয়রানিমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে দমন করা হয়েছে।
উপ-মহাসচিব সুলতান আহমেদের বিরুদ্ধে রেড ক্রিসেন্টের HR বিভাগ একটি তদন্ত চালালেও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তিনি তদন্তকে বাধাগ্রস্ত করেন এবং প্রতিবেদন প্রকাশ হতে দেননি।
বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি দেশের অন্যতম মানবিক সংগঠন। কিন্তু এর নেতৃত্ব ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক প্রভাব, আর্থিক লেনদেন এবং একতরফা নিয়োগ ও পদোন্নতির অভিযোগ প্রতিষ্ঠানটির নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।