ঢাকায় পাকিস্তানের ডিরেক্টর জেনারেল জয়েন্ট স্টাফ লে. জেনারেল তাবাসসুম হাবিব — চারদিনের উচ্চপর্যায়ের প্রতিরক্ষা সফর শুরু
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সফর দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন এক কৌশলগত ভারসাম্য গঠনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। দীর্ঘদিন সীমিত সামরিক যোগাযোগ বজায় রাখার পর দুই দেশের মধ্যে পুনরায় প্রতিরক্ষা সম্পর্কের উষ্ণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
ঢাকায় পাকিস্তানের ডিরেক্টর জেনারেল জয়েন্ট স্টাফ লে. জেনারেল তাবাসসুম হাবিব — চারদিনের উচ্চপর্যায়ের প্রতিরক্ষা সফর শুরু
পাকিস্তানের ডিরেক্টর জেনারেল জয়েন্ট স্টাফ লে. জেনারেল তাবাসসুম হাবিব চারদিনের উচ্চপর্যায়ের প্রতিরক্ষা সফরে আজ ঢাকায় পৌঁছেছেন। এটি বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক কূটনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সফর হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, বিশেষত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এটাই দুই দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের সামরিক যোগাযোগ।
লে. জেনারেল হাবিবের আগমনে বিমানবন্দরে তাঁকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। সফরকালে তিনি বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন বলে জানা গেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সফর দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন এক কৌশলগত ভারসাম্য গঠনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। দীর্ঘদিন সীমিত সামরিক যোগাযোগ বজায় রাখার পর দুই দেশের মধ্যে পুনরায় প্রতিরক্ষা সম্পর্কের উষ্ণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
প্রেক্ষাপট:
১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা প্রায় অনুপস্থিত ছিল। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামরিক পর্যায়ের একাধিক সফর ও বৈঠক ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, দুই দেশই পারস্পরিক কূটনৈতিক ও প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরদারে আগ্রহী।
কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ
:বাংলাদেশ তার প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্ব বৈচিত্র্যময় করার সংকেত দিচ্ছে।
১৯৭১ সালের পর সীমিত সামরিক যোগাযোগের ধারায় পরিবর্তন আসছে।
দক্ষিণ এশিয়ার নতুন ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের কৌশলগত অবস্থান পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
ঢাকায় পাকিস্তানের শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা লে. জেনারেল তাবাসসুম হাবিব
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের শীতল সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস-এর আমন্ত্রণে চারদিনের সরকারি সফরে ঢাকায় পৌঁছেছেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ডিরেক্টর জেনারেল অব জয়েন্ট স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল তাবাসসুম হাবিব।
এটি ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত সর্বোচ্চ পর্যায়ের পাকিস্তানি সামরিক সফর, যা দুই দক্ষিণ এশীয় দেশের সামরিক সম্পর্কের পুনর্জাগরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ঢাকায় পাকিস্তানের ডিরেক্টর জেনারেল জয়েন্ট স্টাফ
লে. জেনারেল তাবাসসুম হাবিব বর্তমানে পাকিস্তানের চাকলালা, রাওয়ালপিন্ডি-স্থিত জয়েন্ট স্টাফ সদর দপ্তরে দায়িত্ব পালন করছেন, যেখানে তিনি সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর মধ্যে আন্তঃসেবা সমন্বয় কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
তিনি চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যার মধ্যে রয়েছেন পাকিস্তান নৌবাহিনীর একজন কমোডর ও একজন মেজর পদমর্যাদার কর্মকর্তা।
বাংলাদেশে তার এই সফর পরিচালনা করছে আর্মড ফোর্সেস ডিভিশন (AFD), যার নেতৃত্বে রয়েছেন লে. জেনারেল এস এম কামরুল হাসান। তিনি নিজেও ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে রাওয়ালপিন্ডি সফর করেছিলেন, যা দুই দেশের সামরিক বাহিনীর পারস্পরিক সংলাপ পুনরুজ্জীবনের সূচনা হিসেবে বিবেচিত হয়।
পাকিস্তানি প্রতিনিধিদল ৬ অক্টোবর রাতে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায়। তাদের জন্য সম্পূর্ণ সামরিক প্রটোকল অনুযায়ী র্যাডিসন ব্লু হোটেল, ঢাকায় থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
৭ অক্টোবর সকালে সেনা কুঞ্জে লে. জেনারেল হাবিবকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হবে। এরপর তিনি লে. জেনারেল কামরুল হাসান-এর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসবেন এবং পরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান-এর সঙ্গে একান্ত আলোচনা করবেন।
এরপর তিনি বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর সদর দপ্তর পরিদর্শন করবেন। সফর চলাকালে তার সম্মানে মধ্যাহ্নভোজ ও নৈশভোজের আয়োজনও থাকবে।
৮ অক্টোবর লে. জেনারেল হাবিব ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ (এনডিসি), মিরপুরে বক্তৃতা প্রদান করবেন। পরে তিনি কক্সবাজারের রামুতে অবস্থিত ১০ পদাতিক ডিভিশন সদর দপ্তর পরিদর্শন করবেন, যা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত ও উপকূলীয় প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ইউনিট।
সেদিন সন্ধ্যায় কক্সবাজারের বে ওয়াচ হোটেলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তার সম্মানে আনুষ্ঠানিক নৈশভোজ আয়োজন করবে। তিনি ৯ অক্টোবর ইসলামাবাদে ফিরে যাবেন।
---
🕊️ প্রতিরক্ষা যোগাযোগের পুনর্জাগরণ
লে. জেনারেল হাবিবের সফর ২০২৫ সালের পুরো সময়জুড়ে চলমান বাংলাদেশ-পাকিস্তান সামরিক বিনিময়ের ধারাবাহিক অংশ।
এর আগে জানুয়ারিতে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর দুই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা, মেজর জেনারেল শাহিদ আমির আফসার ও মেজর জেনারেল আলম আমির আওয়ান, ঢাকায় এসেছিলেন।
জুন মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তিনজন ব্রিগেডিয়ার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দক্ষিণাঞ্চলীয় ঘাঁটি পরিদর্শন করেন। সম্প্রতি আরও তিনজন মেজর জেনারেল গোপনে ঢাকা সফর করেছেন বলে জানা গেছে, যদিও বৈঠকের বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়নি।
এই ধারাবাহিক সফরগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, ইউনুস প্রশাসন বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে আঞ্চলিক সামরিক কূটনীতিকে পুনরায় সক্রিয় করছে।
দুই দেশের সামরিক সম্পর্কের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা কার্যত স্থবির ছিল। তবে ২০০০ সালের দিকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন, যৌথ প্রশিক্ষণ ও সেমিনারের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সম্পর্কের নতুন ভিত্তি তৈরি হয়।
২০১০-এর দশকের শেষের দিকে এই যোগাযোগ আবারও কমে যায়। কিন্তু বর্তমান সময়ের বিনিময় ও উচ্চপর্যায়ের সফর প্রায় এক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো দুই দেশের সামরিক যোগাযোগকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, উভয় দেশের জন্য এই সম্পর্ক বাস্তবিক ও কৌশলগত — জ্ঞান বিনিময়, প্রতিরক্ষা শিক্ষা ও অপারেশনাল সহযোগিতা এর মূল ভিত্তি।
লে. জেনারেল তাবাসসুম হাবিব: পেশাদার সৈনিক ও কৌশলবিদ
১৯৯১ সালে মিডিয়াম রেজিমেন্ট আর্টিলারি থেকে কমিশনপ্রাপ্ত লে. জেনারেল হাবিব একজন অভিজ্ঞ অফিসার। তিনি পূর্বে পাঞ্জাবের ওকারায় ১৪ পদাতিক ডিভিশনের কমান্ডার ছিলেন।
২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে তিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত হন এবং জয়েন্ট স্টাফের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
শিক্ষাগত যোগ্যতা:
এমফিল, পাবলিক পলিসি ও স্ট্র্যাটেজিক সিকিউরিটি ম্যানেজমেন্ট — এনডিইউ, ইসলামাবাদ
মাস্টার্স ইন ডিফেন্স স্টাডিজ — কিংস কলেজ, লন্ডন
মাস্টার্স ইন আর্ট অ্যান্ড সায়েন্স অব ওয়ারফেয়ার — ইউনিভার্সিটি অব বেলুচিস্তান
এক্সিকিউটিভ এডুকেশন ইন পাবলিক পলিসি — হার্ভার্ড কেনেডি স্কুল
এছাড়া তিনি পাকিস্তানের স্পেশাল ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলিটেশন কাউন্সিল (SIFC)-এর চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন, যা সামরিক নেতৃত্বাধীন বিনিয়োগ সমন্বয় সংস্থা হিসেবে কাজ করে।
---
কৌশলগত তাৎপর্য ও ভূরাজনৈতিক বার্তা
ঢাকা এই সফরকে আনুষ্ঠানিকভাবে "সৌজন্যমূলক সফর" হিসেবে বর্ণনা করলেও, এর কৌশলগত বার্তা অনেক গভীর।
বাংলাদেশ এখন ভারতের ও চীনের বাইরেও তার প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্ব বৈচিত্র্যময় করার পথে হাঁটছে। পাকিস্তান ও তুরস্কের মতো আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে অরাজনৈতিক ও পেশাদার সম্পর্ক গড়ে তুলছে, যা বাংলাদেশের স্বাধীন ও ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির প্রতিফলন।
একজন জ্যেষ্ঠ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা BDMilitary-কে বলেন—
> “বাংলাদেশের এই বাস্তববাদী কূটনীতি জাতির প্রতিষ্ঠাতা নীতি ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়’-এরই বাস্তব প্রয়োগ।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা কাঠামোতে ভারত-চীন প্রতিযোগিতা, মিয়ানমারের অস্থিতিশীলতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের পুনঃসংযোজিত আগ্রহের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ এখন একটি “সার্বভৌম কৌশলগত খেলোয়াড়” হিসেবে নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করছে।
---
🧭 মূল বিশ্লেষণ
লে. জেনারেল তাবাসসুম হাবিবের সফর শুধুমাত্র সৌজন্য নয় — এটি বাংলাদেশের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের ঘোষণা।
অন্তর্বর্তীকালীন ইউনুস প্রশাসনের অধীনে বাংলাদেশ স্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে যে, সে আর একক জোট নির্ভর নয় বরং আঞ্চলিক ভারসাম্যের অংশীদার হতে চায়।
দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুত পরিবর্তনশীল ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশের এই কূটনৈতিক বাস্তববাদই তাকে এক নতুন পরিসরে নিয়ে যাচ্ছে —
যেখানে দেশটি নিরপেক্ষতা, পেশাদারিত্ব ও কৌশলগত প্রজ্ঞার মাধ্যমে নিজের অবস্থান নির্ধারণ করছে।