নাফ নদীতে আতঙ্ক: আরাকান আর্মির অপহরণে জেলেদের দুঃস্বপ্ন
২৩ দিনে ৬৩ জেলে নিখোঁজ, কোস্টগার্ডের অভিযানে আটক ১২২ জেলে
নাফ নদীতে আতঙ্ক: আরাকান আর্মির অপহরণে জেলেদের দুঃস্বপ্ন
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী নাফ নদী এখন জেলেদের জন্য ভয়াবহ আতঙ্কের জলপথে পরিণত হয়েছে। মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি নিয়মিতভাবে মাছ আহরণরত বাংলাদেশি জেলেদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। গত ২৩ দিনে এ গোষ্ঠী অন্তত ১০টি ট্রলারসহ ৬৩ জন জেলেকে অপহরণ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
একের পর এক অপহরণ
স্থানীয় সূত্র জানায়, শাহপরীর দ্বীপের নাইক্ষ্যংদিয়ার জলসীমা অংশে প্রায় প্রতিদিনই ঘটে যাচ্ছে অপহরণের ঘটনা। সাগরে মাছ শিকার শেষে ট্রলার নিয়ে ফেরার পথে কিংবা গভীর সমুদ্রে যাওয়ার সময় ওত পেতে থাকা আরাকান আর্মির সদস্যরা স্পিডবোটে ধাওয়া করে জেলেদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে।
ট্রলার মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী:
-
৫ আগস্ট: ১টি নৌকা ও ২ জেলে
-
১২ আগস্ট: ১টি ট্রলার ও ৫ জেলে
-
২৩ আগস্ট: ১টি ট্রলার ও ১২ জেলে
-
২৪ আগস্ট: ২টি ট্রলার ও ১৪ জেলে
-
২৫ আগস্ট: ১টি ট্রলার ও ৭ জেলে
-
২৬ আগস্ট: ২টি ট্রলার ও ১১ জেলে
এইভাবে শুধু আগস্টের ২২ দিনে ৫১ জন জেলে নিখোঁজ হয়েছেন, যাদের এখনো পর্যন্ত ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি। ফলে উপকূলীয় পরিবারগুলোর মধ্যে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
দীর্ঘমেয়াদি অপতৎপরতা
বিজিবি, জেলে ও ট্রলার মালিকদের দেওয়া তথ্যমতে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ২৬ আগস্ট পর্যন্ত নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে ২৫০ জন বাংলাদেশি জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মি। বিজিবির প্রচেষ্টায় এর মধ্যে ১৮৯ জন জেলে ও ২৭টি ট্রলার ফেরত এসেছে। কিন্তু এখনো বহু জেলে নিখোঁজ রয়ে গেছে।
পাচারবিরোধী অভিযানেই ক্ষুব্ধ আরাকান আর্মি?
সম্প্রতি কুতুবদিয়া সাগরে রাখাইনে পাচারের উদ্দেশ্যে নেওয়া ট্রলারভর্তি আলু জব্দ করেছে বাংলাদেশ কোস্টগার্ড। এছাড়া আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণাধীন জলসীমা থেকে চোরাচালানি পণ্য জব্দের ঘটনাও ঘটেছে। স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের মতে, এ কারণে আরাকান আর্মি ক্ষুব্ধ হয়ে জেলেদের অপহরণ করে অর্থ আদায় ও রসদ সংগ্রহের চেষ্টা করছে।
কোস্টগার্ডের পাল্টা অভিযান
অপহরণ থেকে বাংলাদেশি জেলেদের রক্ষা করতে নাফ নদীতে কোস্টগার্ড অভিযান জোরদার করেছে। সম্প্রতি তারা ১৯টি ফিশিং বোটসহ ১২২ জন জেলেকে আটক করে। আটককৃতদের মধ্যে ২৯ জন বাংলাদেশি এবং ৯৩ জন রোহিঙ্গা জেলে।
কোস্টগার্ডের দাবি, যদি তাদের আটক না করা হতো, তাহলে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির হাতে তারা অপহৃত হতো।
প্রশাসন ও বিজিবির অবস্থান
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন জানান, প্রতিদিনই নতুন করে জেলে অপহরণের খবর আসছে। শুধু গত চার দিনে ৬টি ট্রলারসহ ৪৪ জন জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মি।
এদিকে বিজিবির রামু সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বর্তমানে অন্তত ৫১ জন জেলে আরাকান আর্মির হেফাজতে রয়েছে। তাদের নিরাপদে ফেরাতে অনানুষ্ঠানিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। তিনি বলেন, “আরাকান আর্মির সঙ্গে কোনো আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ নেই। তবে আমরা চাপ সৃষ্টি করছি যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো জেলেকে অপহরণ না করা হয়।”
উপকূলে আতঙ্ক
টেকনাফ উপকূলজুড়ে এখন অস্বস্তি ও ভয়ের পরিবেশ বিরাজ করছে। মাছ শিকারে যাওয়া জেলেরা ঝুঁকি নিয়েই নদী ও সাগরে নামছেন। অনেক পরিবার তাদের প্রধান উপার্জনকারীকে হারিয়ে মানবেতর দিন কাটাচ্ছে। ট্রলার মালিক সমিতি দ্রুত অপহৃত জেলেদের মুক্তি ও নাইক্ষ্যংদিয়া এলাকায় নিরাপত্তা জোরদারের দাবি জানিয়েছে।