স্বৈরাচারী জোট’ কতটা ঐক্যবদ্ধ পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে?
৩ সেপ্টেম্বর চীনের সামরিক কুচকাওয়াজে শি, পুতিন ও কিমের উপস্থিতি বিশ্বনেতাদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। অনেকে মনে করছেন, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত হতে পারে। তবে বেইজিং, মস্কো ও পিয়ংইয়ং এখনো সুসংবদ্ধ জোট গঠন থেকে অনেক দূরে।
স্বৈরাচারী জোট’ কতটা ঐক্যবদ্ধ পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে?
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বিরল বৈঠকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন একসঙ্গে হাজির হওয়ার পর যে উষ্ণ সম্পর্কের ছবি ধরা পড়েছে, তার আড়ালে বাস্তবতা কিছুটা ভিন্ন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে সম্পর্ককে "স্বৈরাচারী জোট" বলে অভিহিত করেছে, সেটি পশ্চিমাদের চ্যালেঞ্জ করলেও একে প্রকৃত অর্থে সুসংহত জোট হিসেবে দেখা যাচ্ছে না—বলছেন কূটনীতিক, আইনপ্রণেতা ও বিশ্লেষকরা।
উদ্বেগ বাড়াচ্ছে এশিয়ার অক্ষ
৩ সেপ্টেম্বর চীনের সামরিক কুচকাওয়াজে শি, পুতিন ও কিমের উপস্থিতি বিশ্বনেতাদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। অনেকে মনে করছেন, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত হতে পারে। তবে বেইজিং, মস্কো ও পিয়ংইয়ং এখনো সুসংবদ্ধ জোট গঠন থেকে অনেক দূরে।
একজন মার্কিন কূটনীতিক (এশিয়ায় কর্মরত, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, “চীন, রাশিয়া এবং উত্তর কোরিয়ার মধ্যে নীতিগত পার্থক্য থাকবেই। তবে তারা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে মার্কিন নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাদের ঐক্য রয়েছে।”
জাপানের বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা তার পদত্যাগী ভাষণে উল্লেখ করেন, পারমাণবিক অস্ত্রধারী এই প্রতিবেশীদের পাশাপাশি দাঁড়ানো জাপানের নিরাপত্তার জন্য বড় ঝুঁকি। ইইউ’র পররাষ্ট্রনীতির প্রধান কায়া কাল্লাসও এই সমাবেশকে “বর্ধমান স্বৈরাচারী জোট” হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
ট্রাম্প বনাম জোট
ডোনাল্ড ট্রাম্প ট্রুথ সোশালে লিখেছেন, শি, পুতিন ও কিম তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। ক্রেমলিন অবশ্য মন্তব্যটিকে ব্যঙ্গাত্মক বলে আখ্যা দেয়। এক মার্কিন কর্মকর্তা জানান, ট্রাম্প হতাশ যে কিছু দেশ চীনের পাশে দাঁড়াচ্ছে এবং যুক্তরাষ্ট্র পরিস্থিতি নতুন করে মূল্যায়ন করবে।
এই সামরিক কুচকাওয়াজ শির জন্য কূটনৈতিক সাফল্য বয়ে আনে। এটি পুতিনকে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমাদের প্রচারণার মোকাবিলায় সহায়তা করে এবং কিমের নিষিদ্ধ পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচিকে পরোক্ষ সমর্থন দেয়। তবে তিন নেতা একসঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসেননি।
ওয়াশিংটনভিত্তিক উত্তর কোরিয়া বিষয়ক সংস্থা "৩৮ নর্থ"-এর পরিচালক জেনি টাউন বলেন, “চীন যেন ইঙ্গিত দেয়নি যে কোনো আনুষ্ঠানিক ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতা শুরু হচ্ছে।” বিশ্লেষকরা বলছেন, যৌথ সামরিক মহড়ার মতো সরাসরি প্রদর্শন এখনো দূরের বিষয়।
অর্থনৈতিক দিক
সম্মেলনে সবচেয়ে বড় ঘোষণাটি ছিল রাশিয়া ও চীনের মধ্যে একটি গ্যাস পাইপলাইনের ব্যাপারে "বাধ্যতামূলক সমঝোতা স্মারক"। তবে চীন বিষয়টি তাদের সরকারি বিবৃতিতে উল্লেখ করেনি এবং সংবাদ সম্মেলনেও এ নিয়ে প্রশ্ন এড়িয়ে গেছে। পাইপলাইন প্রকল্পটি ৩,০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে বলে ধরা হচ্ছে, তবে মূল্য ও শর্ত নিয়ে অমিলের কারণে প্রকল্পটি স্থবির হয়ে আছে।
এছাড়া, পুতিনের সফরসঙ্গী কৃষিমন্ত্রী অক্সানা লুট আশা করেছিলেন চীন তাদের শীতকালীন গমের বাজার খুলে দেবে। কিন্তু বেইজিং এতে সায় দেয়নি। যদিও কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে চীন তাদের বন্ড মার্কেট রাশিয়ার জন্য খুলে দিতে পারে। রাশিয়ার অর্থ মন্ত্রণালয় অবশ্য সতর্ক করে জানিয়েছে, তারা চাইবে বন্ডগুলো স্থানীয়ভাবে ইস্যু হোক।
ট্রাম্প ফ্যাক্টর
শির সঙ্গে কিমের ছয় বছর পর প্রথম বৈঠকে শীর্ষ চীনা অর্থনৈতিক কর্মকর্তাদের উপস্থিতি ইঙ্গিত দেয় যে বাণিজ্য আলোচনাও ছিল মূল এজেন্ডায়। বেইজিংয়ের সরকারি বিবৃতিতে দীর্ঘদিন পর প্রথমবারের মতো "পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ" শব্দটি অনুপস্থিত ছিল। অনেক বিশ্লেষক একে কিমের প্রতি বড় ছাড় হিসেবে দেখছেন।
এ প্রসঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বেইজিংকে আহ্বান জানিয়েছে—পিয়ংইয়ংকে আলোচনায় ফেরাতে তারা যেন গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে। চীনা রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানায়, সম্মেলনের পর শি কিমকে পাঠানো এক চিঠিতে বলেছেন, বেইজিং উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে কৌশলগত যোগাযোগ জোরদার করতে প্রস্তুত।
তবে উত্তর কোরীয় শ্রমিকদের অবস্থানসহ অনেক জটিল বিষয় এখনো অমীমাংসিত। অনেকে মনে করছেন, কিমকে কেন্দ্র করে এই সৌহার্দ্যপূর্ণ ভাষা আসলে ওয়াশিংটনের সঙ্গে দরকষাকষির হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহার করছে বেইজিং।
অক্টোবরে দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক কো-অপারেশন (APEC) সম্মেলনে ট্রাম্পের সফর সম্ভাব্য বৈঠকের মঞ্চ তৈরি করতে পারে। এ সময় ট্রাম্প ও শির মধ্যে বাণিজ্য ইস্যুতে আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।
২০১৯ সালে ব্যর্থ আলোচনার পর থেকে কিম ট্রাম্পের সঙ্গে পুনরায় সংলাপ শুরু করার কোনো ইঙ্গিত দেননি। তবে দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়েন্দারা সতর্ক নজর রাখছে, সাম্প্রতিক কূটনৈতিক তৎপরতা হয়তো নতুন কোনো সুযোগ তৈরি করতে পারে কিনা।
ভারতের সর্বশেষ অবস্থান: জোটে নীরব সমর্থন?
ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে চীন-রাশিয়া-উত্তর কোরিয়ার এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে প্রকাশ্যে খুব একটা মন্তব্য করেনি। তবে দিল্লি এখনো রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও জ্বালানি খাতে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে ভারত রাশিয়ার তেল আমদানি কয়েকগুণ বাড়িয়েছে।
একইসঙ্গে, ভারত পশ্চিমাদের ‘কোয়াড’ (যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে) জোটেও আছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে চীনের প্রতি তুলনামূলক নরম সুর, রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ লেনদেন এবং পশ্চিমা নীতির প্রতি দ্বিধান্বিত অবস্থান অনেককে ভাবাচ্ছে—ভারত কি অঘোষিতভাবে এই ‘স্বৈরাচারী জোট’-এর দিকে ঝুঁকছে?
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারত এখন কৌশলগতভাবে দুই দিকেই খেলছে—একদিকে পশ্চিমাদের সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতা, অন্যদিকে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে বাস্তবমুখী অর্থনৈতিক সম্পর্ক। ফলে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা সম্ভাব্য নতুন জোটে ভারতের ভূমিকা “নীরব সমর্থক” হিসেবে দেখা যেতে পারে।