চীন দেখাল শক্তি, ঐক্য ও ভবিষ্যতের বার্তা: শি জিনপিংয়ের কূটনৈতিক ঝড়ে বিশ্ব দৃষ্টি আকর্ষণ
দশ বছর পর, এবং অভ্যন্তরীণ বিরোধিতা সরিয়ে দিয়ে অভূতপূর্ব তৃতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে, এবার ৮০তম বার্ষিকীর কুচকাওয়াজে শি জিনপিংয়ের পাশে বসেন রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন ও উত্তর কোরিয়ার কিম জং উন। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদেরও বিদেশি অতিথিদের সঙ্গে পাশাপাশি রাখা হয়েছিল।
চীন দেখাল শক্তি, ঐক্য ও ভবিষ্যতের বার্তা: শি জিনপিংয়ের কূটনৈতিক ঝড়ে বিশ্ব দৃষ্টি আকর্ষণ
২০১৫ সালে চীনের নেতা শি জিনপিং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি উপলক্ষে প্রথমবারের মতো সামরিক কুচকাওয়াজ আয়োজন করেছিলেন। সে সময় তিনি তার দুই পূর্বসূরিকে পাশে বসিয়েছিলেন— নেতৃত্বের প্রতি সম্মান ও ধারাবাহিকতা প্রদর্শনের অংশ হিসেবে।
দশ বছর পর, এবং অভ্যন্তরীণ বিরোধিতা সরিয়ে দিয়ে অভূতপূর্ব তৃতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে, এবার ৮০তম বার্ষিকীর কুচকাওয়াজে শি জিনপিংয়ের পাশে বসেন রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন ও উত্তর কোরিয়ার কিম জং উন। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদেরও বিদেশি অতিথিদের সঙ্গে পাশাপাশি রাখা হয়েছিল।
কুচকাওয়াজের আগে শি জিনপিং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তিয়ানজিনে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও)-এর শীর্ষ বৈঠকে উচ্চপর্যায়ের সাক্ষাৎ করেন এবং গত মাসে বিরলভাবে তিব্বত সফর করেন।
কূটনৈতিক শক্তি, সহনশীলতা ও ভূরাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার এই প্রদর্শন চীনা পর্যবেক্ষকদের মধ্যে শি-র স্বাস্থ্য ও উত্তরসূরি পরিকল্পনা নিয়ে তৈরি হওয়া শঙ্কা কমিয়ে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি দেশীয় অর্থনৈতিক মন্দার দিক থেকে জনগণের দৃষ্টি সরাতেও সহায়ক হয়েছে।
বেইজিংয়ের তিয়ানআনমেন স্কোয়ারে নেতারা যখন মঞ্চের দিকে এগোচ্ছিলেন, তখন শি ও পুতিন এক হট-মাইকে ধরা পড়েন অঙ্গ প্রতিস্থাপন এবং মানুষের ১৫০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে।
এশিয়া সোসাইটির (নিউইয়র্কভিত্তিক থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক) নীল থমাস বলেন, “এই সপ্তাহের বিজয়ী কূটনীতি প্রমাণ করেছে যে শি এখনো কমিউনিস্ট পার্টির অভিজাত রাজনীতিতে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছেন।” তিনি যোগ করেন, পূর্বসূরিদের মতো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি থেকে বৈধতা না পেয়ে শি জাতীয়তাবাদকেই হাতিয়ার করেছেন জনগণকে একত্রিত করার জন্য।
“এটি অর্থনৈতিক সংকট থেকে মনোযোগ সরানোর উপায়, এবং নাগরিকদের চীনা হিসেবে গর্বিত করার চেষ্টা, যদিও বেকারত্ব, বাড়ির দাম কমা এবং স্থবির মজুরি দেখে প্রতিদিনের বাস্তবতায় তা অনুভব করা কঠিন।”
বয়োজ্যেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়কের ভাবমূর্তি জোরদার করতে শি এদিন মাও সেতুং-শৈলীর ধূসর রঙের পোশাক পরেন, যা তার পাকা চুলের সঙ্গে মানানসই ছিল। এতে তিনি তার সমসাময়িকদের কালো স্যুট এবং এক দশক আগের নিজের কালো পোশাক থেকে আলাদা হয়ে দাঁড়ান।
শি’র ডেপুটি, প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং, যিনি বর্তমানে দেশে গুরুত্ব হারিয়েছেন, তাকে তুলনামূলকভাবে গৌণ বৈঠক যেমন মালয়েশিয়া ও উজবেকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাতের দায়িত্ব দেওয়া হয়। অন্যদিকে কিম, মোদি, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়েপ এরদোয়ানসহ উচ্চপর্যায়ের সাক্ষাতের দায়িত্ব পান পার্টির কেন্দ্রীয় সচিবালয়ের প্রধান সাই ছি।
রয়টার্সের মন্তব্যের অনুরোধে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাম্প্রতিক কূটনৈতিক ঘটনাবলির সংবাদ সম্মেলনের প্রতিলিপির দিকে ইঙ্গিত করে জানায়, এসব সাক্ষাত চীনের উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্ব এবং শান্তিপূর্ণ উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি তুলে ধরেছে।
অনেক দেশ—যেমন ভারত—যারা এখনো রাশিয়ার তেল আমদানি করে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক এবং রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের কারণে নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছে।
সবচেয়ে আলোচিত মুহূর্তগুলির মধ্যে ছিল মোদি ও পুতিনের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে শি’র সঙ্গে আলাপচারিতা, যা ট্রাম্প ও মোদির ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং রাশিয়া-চীনের বিপরীতে ভারতের ঐতিহাসিক নিরপেক্ষ অবস্থানে ওয়াশিংটনের ব্যর্থতা তুলে ধরে।
কৌশলগত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ট্রিভিয়াম চায়নার পরিচালক ইভেন পে বলেন, “এসসিও-তে সংহতির অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি ছিল মার্কিন নীতি।”
ট্রাম্প এই সামরিক কুচকাওয়াজকে “সুন্দর” এবং “খুবই চিত্তাকর্ষক” বলে উল্লেখ করলেও সামাজিক মাধ্যমে কটাক্ষ করে লেখেন, চীন, পুতিন ও কিম “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।”
রাশিয়া পাল্টা জানায়, তারা কোনো ষড়যন্ত্র করছে না, বরং ট্রাম্পের মন্তব্যই ছিল বিদ্রূপাত্মক।
ট্রাম্পের আঘাত, শি’র আতিথেয়তা
বিশ্লেষকরা বলছেন, শি’র এই ব্যস্ত কূটনীতি চীনের সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন, যেখানে দেশটি উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করছে—বিনিয়োগ সুযোগ এবং নতুন উন্নয়ন ব্যাংকের মতো উদ্যোগের মাধ্যমে। এটি এসসিও’র জন্য বড় অগ্রগতি, যা গত কয়েক দশকে ভারত, পাকিস্তান এবং ইরানকেও অন্তর্ভুক্ত করেছে।
চায়না-গ্লোবাল সাউথ প্রজেক্টের সম্পাদক এরিক ওল্যান্ডার বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় বেশি নির্ভরযোগ্য ও স্থিতিশীল অংশীদার হিসেবে চীনের বার্তা এখন এশিয়ার বিস্তৃত জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাচ্ছে, যারা যুক্তরাষ্ট্রকে ক্রমশ বিশ্বে যুদ্ধবাজ শক্তি হিসেবে দেখছে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “বহু উন্নয়নশীল ও মাঝারি শক্তিধর রাষ্ট্র এখনো চীনের নতুন শাসন ও উন্নয়ন প্রস্তাব নিয়ে দ্বিধায় আছে। তবে অন্তত চীন যে আলোচনাগুলো করছে তা ভবিষ্যতমুখী, যা যুবসমৃদ্ধ দেশগুলোর জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির আশা জাগায়।”
শি ২০২৭ সালে সম্ভাব্য চতুর্থ মেয়াদের দিকে নজর রাখছেন—নিজেকে মাও সেতুংয়ের পর সবচেয়ে শক্তিশালী চীনা নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্য নিয়ে।
তবে চীনের পুরোনো বৈদেশিক নীতি—যেমন সীমান্ত বিরোধ ও ভর্তুকিযুক্ত শিল্প রপ্তানি—বিদেশি বাজারে সস্তা পণ্যের জোয়ার তুলেছে, যা আগামী দিনে দ্বন্দ্বের কারণ হবে। আর ভারতের সঙ্গে চীনের গভীর অবিশ্বাস একটি স্বল্প বৈঠকে দূর হওয়ার নয়।
এশিয়া সোসাইটির নীল থমাসের ভাষায়, “এটি অপরিহার্যভাবে চীন নেতৃত্বাধীন একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থার দিকে বড় ধরণের পরিবর্তন নয়।”