রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে "কৌশলগত অংশীদারিত্ব": রাশিয়া-চীন সম্পর্ক নিয়ে পুতিন

"রাশিয়া-চীন বৈঠক বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হবে। আমাদের দ্বিপাক্ষিক এজেন্ডার সব দিক নিয়ে আলোচনা করা হবে, পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়েও মতবিনিময় হবে। রাশিয়া-চীনের কৌশলগত অংশীদারিত্ব একটি স্থিতিশীলকারী শক্তি হিসেবে কাজ করছে।”

PostImage

রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে "কৌশলগত অংশীদারিত্ব": রাশিয়া-চীন সম্পর্ক নিয়ে পুতিন


বাণিজ্যের পরিমাণের দিক থেকে রাশিয়া ও চীনের মধ্যে লেনদেন এখন মূলত রুবল ও ইউয়ানে হচ্ছে, যেখানে ডলার বা ইউরোর অংশ “পরিসংখ্যানগত অপ্রাসঙ্গিকতায় নেমে এসেছে” বলে জোর দিয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আন্তর্জাতিক রাজনীতি থেকে শুরু করে সিনেমা ও খেলাধুলা পর্যন্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাশিয়া-চীন সম্পর্কের উচ্চমানের প্রশংসা করেছেন। চীনা বার্তা সংস্থা সিনহুয়া-কে দেওয়া এক লিখিত সাক্ষাৎকারে তিনি চীন সফরের এজেন্ডা ও দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং বিশ্বকে তারা কী দিতে পারে সে বিষয়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। সফর শুরুর একদিন আগে ক্রেমলিনের ওয়েবসাইটে সাক্ষাৎকারটির পূর্ণাঙ্গ পাঠ প্রকাশ করা হয়।


এসসিও সম্মেলন ও বেইজিংয়ে আলোচনা

পুতিন বলেন,
“আমি তিয়ানজিন শহর সফরের জন্য খুবই আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি। এখানে চীনের সভাপতিত্বে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। আমরা আশা করি সম্মেলনটি সংগঠনকে নতুন গতি দেবে, সমসাময়িক চ্যালেঞ্জ ও হুমকির মোকাবিলায় সক্ষমতা বাড়াবে এবং ইউরেশিয়া অঞ্চলে সংহতি দৃঢ় করবে। এগুলো একটি ন্যায়সঙ্গত বহুমেরু বিশ্বব্যবস্থা গঠনে সহায়ক হবে।”

তিনি আরও বলেন,
“রাশিয়া-চীন বৈঠক বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হবে। আমাদের দ্বিপাক্ষিক এজেন্ডার সব দিক নিয়ে আলোচনা করা হবে, পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়েও মতবিনিময় হবে। রাশিয়া-চীনের কৌশলগত অংশীদারিত্ব একটি স্থিতিশীলকারী শক্তি হিসেবে কাজ করছে।”


যুদ্ধস্মৃতি

চীনা রাজধানীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের ৮০তম বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণ অনুষ্ঠানের কথাও উল্লেখ করেন পুতিন।

তিনি বলেন,
“প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তার দেশের ইতিহাসকে সর্বোচ্চ সম্মানের সঙ্গে দেখেন—ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় আমি এটি অনুভব করেছি। তিনি এক মহান শক্তিধর রাষ্ট্রের প্রকৃত নেতা, দৃঢ় সংকল্পের মানুষ, কৌশলগত দৃষ্টি ও বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন এবং জাতীয় স্বার্থে অবিচল প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বর্তমান জটিল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে তার মতো একজন ব্যক্তির নেতৃত্বে থাকা চীনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”

পুতিন আরও বলেন,
“সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের জনগণ যুদ্ধের সবচেয়ে বড় বোঝা বহন করেছে এবং সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে তাদের মধ্যে। রাশিয়া কখনো ভুলবে না যে চীনের বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ জাপানকে ১৯৪১-৪২ সালের সবচেয়ে অন্ধকার সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের পেছনে আঘাত হানতে বাধা দেয়। এর ফলে লাল সেনা সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারে নাৎসিবাদ দমন ও ইউরোপ মুক্ত করার কাজে।”


ইউরোপ ও জাপানের সামরিকীকরণ

“আমরা কৃতজ্ঞ চীনের প্রতি, কারণ তারা চীন মুক্ত করতে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া লাল সেনাদের স্মৃতিসৌধগুলো যত্নের সঙ্গে সংরক্ষণ করে আসছে,” বলেন পুতিন।

তিনি আরও বলেন,
“অতীতের প্রতি এ ধরনের আন্তরিক ও দায়িত্বশীল দৃষ্টিভঙ্গি কিছু ইউরোপীয় দেশের অবস্থার সঙ্গে তীব্র বৈপরীত্য তৈরি করে, যেখানে সোভিয়েত মুক্তিদাতাদের স্মৃতিস্তম্ভ ও কবরগুলো বর্বরোচিতভাবে অপমান বা ধ্বংস করা হয়, এবং অস্বস্তিকর ঐতিহাসিক সত্যগুলো মুছে ফেলা হয়। আমরা দেখছি, কিছু পশ্চিমা রাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফলকে কার্যত অস্বীকার করছে এবং ন্যুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রাইব্যুনালের রায়গুলোকে প্রকাশ্যে উপেক্ষা করছে।”

“জাপানি সামরিকবাদ আবারও জীবিত হচ্ছে কল্পিত রুশ বা চীনা হুমকির অজুহাতে। ইউরোপে, বিশেষ করে জার্মানিতে, মহাদেশকে পুনরায় সামরিকীকরণের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, ঐতিহাসিক পরিণতির প্রতি সামান্যতম গুরুত্ব না দিয়েই।”


তেল, গ্যাস, রুবল ও ইউয়ান

“বাণিজ্যের পরিমাণের দিক থেকে রাশিয়া ও চীনের মধ্যে লেনদেন এখন মূলত রুবল ও ইউয়ানে হচ্ছে, ডলার বা ইউরোর অংশ মাত্র পরিসংখ্যানগত অপ্রাসঙ্গিকতায় নেমে এসেছে,” বলেন পুতিন।

তিনি আরও জানান,
“চীনের শীর্ষ তেল ও গ্যাস রপ্তানিকারক হিসেবে রাশিয়া তার অবস্থান ধরে রেখেছে। ২০১৯ সালে পাওয়ার অব সাইবেরিয়া পাইপলাইন চালু হওয়ার পর থেকে ইতোমধ্যে ১০০ বিলিয়ন ঘনমিটারের বেশি প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে। ২০২৭ সালে আমরা আরেকটি বড় গ্যাস রুট—‘ফার ইস্টার্ন রুট’ চালুর পরিকল্পনা করছি।”

“আমরা যৌথভাবে বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা কমাতে কাজ করছি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনে শূকর ও গরুর মাংস রপ্তানি শুরু হয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়া এখন চীনা গাড়ি রপ্তানির অন্যতম বড় বাজার।”

“শুধু তাই নয়, রাশিয়ায় চীনা গাড়ি নয়, গৃহস্থালি যন্ত্রপাতির উৎপাদনও স্থানীয়ভাবে হচ্ছে। নির্মাণ সামগ্রী শিল্পেও আমাদের বৃহৎ পরিকল্পনা রয়েছে।”


সিনেমা, খেলাধুলা ও শিক্ষা

“রাশিয়া-চীন সাংস্কৃতিক বর্ষ সফলভাবে আয়োজন করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট শি এবং আমি একমত হয়েছি যে ২০২৬-২৭ সাল হবে রাশিয়া-চীন শিক্ষা বর্ষ,” জানান পুতিন।

তিনি বলেন,
“রাশিয়া ইন্টারভিশন ইন্টারন্যাশনাল সং কনটেস্টের উদ্যোগ নিয়েছে, যা এ বছরের ২০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হবে। আমাদের চীনা অংশীদাররা এতে গভীর আগ্রহ দেখিয়েছে।”

“আমরা কৃতজ্ঞ আমাদের চীনা অংশীদারদের প্রতি, যারা রাশিয়া আয়োজিত আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি খেলাধুলা রাজনীতির বাইরে থাকা উচিত।”

“আমরা আশা করছি অদূর ভবিষ্যতে অনেক নতুন রাশিয়া-চীন চলচ্চিত্র মুক্তি পাবে। এই সিনেমাগুলো সুস্থ নৈতিক মূল্যবোধ, ঐতিহ্যবাহী আধ্যাত্মিক ও নৈতিক আদর্শ প্রচার করবে এবং গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সত্যনিষ্ঠ চিত্র উপস্থাপন করবে। এ উদ্দেশ্যে আমরা ‘ওপেন ইউরেশিয়ান ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড’ চালু করেছি—যা হবে এক অনন্য চলচ্চিত্র প্ল্যাটফর্ম, পক্ষপাত ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত।”

“পর্যটন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ পারস্পরিক পর্যটক প্রবাহ ২.৫ গুণ বেড়ে ২.৮ মিলিয়নে পৌঁছেছে, যা অত্যন্ত ইতিবাচক।”


জাতিসংঘ সংস্কার ও ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান

“রাশিয়া ও চীন জাতিসংঘ সংস্কারের পক্ষে, যাতে এটি তার পূর্ণ মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে পারে এবং আধুনিক বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করতে পারে। বিশেষ করে আমরা চাই নিরাপত্তা পরিষদকে আরও গণতান্ত্রিক করা হোক, যেখানে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার রাষ্ট্রগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে,” জোর দেন পুতিন।

তিনি আরও বলেন,
“আমরা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) ও বিশ্বব্যাংক সংস্কারেরও সমর্থন করি।”

“অর্থনীতিকে ঔপনিবেশিকতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করা জরুরি, যা বৈশ্বিক সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থের পরিপন্থী। বরং আমরা মানবজাতির সার্বিক অগ্রগতি চাই।”

পুতিন উল্লেখ করেন, রাশিয়া ও চীন জি-২০, ব্রিকস এবং এপেক-এর মতো আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করছে।

সিএসবি নিউজ-এর আরও খবর